৮ রাকাত তারাবীর দলীলসমূহ ও তার জবাব

৮ রাকাত তারাবীর দলীলসমূহ ও তার জবাব
১নং দললি
حَدَّثَنَا إِسْمَاعِيلُ، قَالَ حَدَّثَنِي مَالِكٌ، عَنْ سَعِيدٍ الْمَقْبُرِيِّ، عَنْ أَبِي سَلَمَةَ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ، أَنَّهُ سَأَلَ عَائِشَةَ ـ رضى الله عنها ـ كَيْفَ كَانَتْ صَلاَةُ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فِي رَمَضَانَ فَقَالَتْ مَا كَانَ يَزِيدُ فِي رَمَضَانَ، وَلاَ فِي غَيْرِهَا عَلَى إِحْدَى عَشْرَةَ رَكْعَةً، يُصَلِّي أَرْبَعًا فَلاَ تَسَلْ عَنْ حُسْنِهِنَّ وَطُولِهِنَّ، ثُمَّ يُصَلِّي أَرْبَعًا فَلاَ تَسَلْ عَنْ حُسْنِهِنَّ وَطُولِهِنَّ، ثُمَّ يُصَلِّي ثَلاَثًا‏.‏ فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ، أَتَنَامُ قَبْلَ أَنْ تُوتِرَ قَالَ ‏ “‏ يَا عَائِشَةُ إِنَّ عَيْنَىَّ تَنَامَانِ وَلاَ يَنَامُ قَلْبِي ‏”‏‏
হযরত আবু সালমা বিন আব্দুর রহমান থেকে বর্ণিত তিনি আয়েশা রাঃ এর কাছে জানতে চান নবীজী সাঃ এর নামায কেমন হত রামাযান মাসে? তিনি বললেন-রাসূল সাঃ রামাযান ও রামাযান ছাড়া ১১ রাকাত থেকে বাড়াতেন না। তিনি ৪ রাকাত পড়তেন তুমি এর সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে জানতে চেওনা। তারপর পড়তেন ৪ রাকাত তুমি এর সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা বিষয়ে জানতে চেওনা, তারপর পড়তেন ৩ রাকাত। হযরত আয়েশা রাঃ বলেন-তখন আমি বললাম-হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি বিতর পড়ার পূর্বে শুয়ে যান? তিনি বললেন-হে আয়েশা! নিশ্চয় আমার দু’চোখ ঘুমায় আমার কলব ঘুমায়না। (সহীহ বুখারী-১/১৫৪)
এ হাদীসটিই তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী দলীল কিন্ত আসল কথা হল, এই হাদিসটি তাহাজ্জুদ সর্ম্পকে। এতে তারাবীহের কথা বর্ণিত হয়নি। নিম্নে এ ব্যাপারে কিছু প্রমাণ উপস্থাপন করা হল:
জবাব:১-
এ হাদীসে ইযতিরাব তথা অস্পষ্টতা ও পরস্পর বিরোধিতা থাকায় এ দিয়ে দলিল দেয়া ঠিক নয়। আল্লামা কুরতুবী রাহ. বলেন-আমি আয়েশা রা. এর এই বর্ণনাটি অনেক আহলে ইলমদের কাছে জিজ্ঞাসা করেছি অনেকেই এতে অস্পষ্টতা ও পরস্পর বিরোধিতা আছে বলে মত প্রকাশ করেছেন। (ফাতহুল বারী শরুহুল বুখারী-৩/১৭)
২- খোদ হযরত আয়েশা রা. থেকে ১৩ রাকাত তারাবীহের কথা সহীহ সনদে বর্ণিত আছে। সুতরাং হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী অস্পষ্টতা ও পরস্পর বিরোধিতা দূর করতে এই পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন-“সঠিক কথা হল এ ব্যাপারে আমি যা উল্লেখ করেছি এগুলো সব ভিন্ন সময় ও ভিন্ন পরিস্থিতির উপর নির্ভরশীল” অর্থাৎ নবীজী একেক সময় একেক রাকাত নামায পড়েছেন তারাবীহের ক্ষেত্রে।(ফাতহুল বারী-৩/১৭)
এর মাধ্যমে কথিত আহলে হাদিসদের “৮ রাকাতের মাঝেই তারাবীহ নামায সীমাবদ্ধ এরচে’ বেশী তারাবীহ নামায নেই” এই দাবিটি বাতিল হয়ে যাচ্ছে। খোদ আহলে হাদিসদের আলেম মাওলানা আব্দুর রহমান মুবারকপুরী বলেন-নিশ্চয় একথা প্রমাণিত যে রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ১৩ রাকাত তারাবীহ পড়েছেন ফজরের দু’রাকাত সুন্নত ছাড়াই। (তুহফাতুল আহওয়াজী-২/৩)
৩-এই হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হল রাৈসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক সালামে ৪, ৪ রাকাত করে তারাবীহ আর শেষে এক সালামে ৩ রাকাত বিতর পড়েছেন, অথচ কথিত আহলে হাদিসদের আমল এর বিপরীত। তারা তারাবীহ দুই দুই রাকাত করে পড়েন। আর বিতর এক রাকাত বা তিন রাকাত দুই সালামে পড়েন। সুতরাং যেই হাদিস দলিলদাতাদেরু কাছে আমলহীন এর দ্বারা দলিল দেয়া যায়?
৪-এ হাদীসে যে নামাযের কথা বলা হয়েেেছ তা রমজান ও অন্য সময় পড়া হতো, অথচ তারাবী রমজান ছাড়া অন্য সময় পড়া হয় না।
৫- এখানে যে নামাযের কথা আছে তা রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘরে একাকী পড়তেন। অথচ তারাবীর নামায মসজিদে জামাতের সঙ্গে পড়া হয়।
৬- যেখানে যে নামাযের কথা আছে তার পরে রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিতেন। পরে ঘুম থেকে উঠে বেতের পড়তেন। অথচ তারাবীর নামায শেষ করে সঙ্গে সঙ্গে বেতের পড়া হয়। তা ছাড়া এখানে আছে তিনি বেতের একাকী পড়তেন। অথচ রমজানে বেতের জামাতের সঙ্গে পড়া হয়।
২নং দলীল :
عن جابر بن عبد الله رضي الله عنهما قال: صلَّى بِنَا رسول الله صلى الله عليه وسلم في رمضان ثَمَان رَكَعَات والوِتر، فَلَمَّا كَانَ مِنَ القَابِلَة اجْتَمَعْنَا فِيْ المَسْجِدِ وَرَجَونا أن يَخْرُجَ إِلَينَا، فلم نَزَلْ فِيْ المَسْجِدِ حَتَّى أَصْبَحْنَا، فدَخَلْنَا عَلى رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقُلْنَا لَهُ: يَا رَسُوْلَ الله، رَجَوْنَا أن تَخْرُجَ إِلَينَا فَتُصَلِّي بِنَا، فقال: ্রكَرِهت أن يُكْتَب عَلَيْكُمْ الْوِتْرَ.
হযরত জাবের রাঃ থেকে বর্ণিত তিনি বলেন-রাসূল সাঃ আমাদের সাথে রামযানে ৮ রাকাত নামায ও বিতর নামায পড়লেন, তারপর যখন পরদিন হল আমরা মসজিদে একত্রিত হলাম এবং আকাংখা করলাম নবীজী সাঃ আমাদের কাছে আসবেন। আমরা মসজিদে অবস্থান করতে লাগলাম। প্রভাত হয়ে গেল। তখন আমরা গেলাম নবীজী সাঃ এর কাছে। তাকে বললাম-হে আল্লাহর রাসূল! আমরা আকাংখী ছিলাম আপনি আমাদের কাছে যাবেন এবং আমাদের নিয়ে নামায পড়বেন, তখন তিনি বললেন-আমি এটি পছন্দ করছিলামনা যে, তোমাদের উপর বিতর ফরয হয়ে যাক।
সূত্র:(মসনাদে আবী ইয়ালা: ১৭৯৫,মুঝামুল আওসাত: ৩৭৩১, যাওয়ায়েদে মুসনাদে: ২১৪১৫, কিয়ামুল লাইল-৯০)
জবাব:
এই হাদিসটি নিয়ে কথিত আহলে হাদিসদের সবচে বেশি খুশি হতে দেখা যায়। অথচ আশ্চর্যের বিষয় হল এই হাদিসটি একাধিক কিতাবে বর্ণিত হলেও সকলেই একই সনদে বা সূত্রে বর্ণনা করেছেন।কিন্তু হাদিীসটি দুর্বল। এটি প্রমাণযোগ্য নয়।কারণ:
ক. শুধু একজন নয় এই হাদিসের তিনজন রাবীর ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসীনে কিরাম বলেছেন তারা গ্রহণযোগ্য নয়। দেখুন মুহাদ্দিসীনে কিরাম কি বলে এই হাদিসের বর্ণনাকারীদের ব্যাপারে।
প্রথমতঃ ইবনে হুমাইদ রাজী, হাফেজ জাহাবী রহঃ বলেন-তিনি দুর্বল। ইমাম বুখারী রহঃ বলেন-এতে আপত্তি আছে। আবু জুরআ রহঃ বলেন-তিনি মিথ্যাবাদী। ইসহাক কু’সজ রহঃ বলেন-আমি স্বাক্ষ্য দিচ্ছি তিনি মিথ্যাবাদী। ইমাম নাসায়ী রহঃ বলেন-সে গ্রহণযোগ্য নয়। (মিযানুল ই’তিদাল-৩/৪৯-৫০)
দ্বিতীয়তঃ ইয়াকুব বিন আব্দুল্লাহ আশআরী
ইমাম দারা কুতনী রহঃ বলেন-সে শক্তিশালী নয় (মিযানুল ই’তিদাল-৩/৩২৪)
তৃতীয়তঃ ঈসা বিন জারিয়া, ইমাম নাসায়ী বলেন-مَتْرُوْكُ الْحَدِيْثِ তার হাদিস অগ্রহণীয়। আল্লামা জাহাবী বলেন-তিনি দুর্বলদের মাঝে শামীল (মিযানুল ই’তিদাল-২/৩১১)
এছাড়াও এ হাদিসে আরেকটি সমস্যা আছে, তাহল-এই হাদিসে বিতর ফরয হবার আশংকার কথা বলা হয়েছে অথচ অন্য সহীহ হাদিসে তারাবীহ ফরয হয়ে যাবার আশংকা উল্লেখ করা হয়েছে। (মিযানুল ই’তিদাল-২/৪২-৪৩)
এছাড়া হযরত জাবের রাঃ ইন্তেকাল করেছেন ৭০ হিজরীর পর মদীনায়। কমপক্ষে ৫৫ বছর যাবত তার সামনে মদীনা মুনাওয়ারায় মসজিদে নববীতে বিশ রাকাতের কথিত বিদআত চালু ছিল। আর হযরত জাবের রাঃ নিজের জবানে রাসূল সাঃ থেকে হাদীস বর্ণিত যে, وَشَرَّ الأُمُورِ مُحدَثَاتُهَا، وَكُلَّ مُحدَثَةٍ بِدعَةٌ، وَكُلَّ بِدعَةٍ ضَلالَةٌ، وَكُلَّ ضَلالَةٍ في النَّارِ.তথা প্রত্যেক নব উদ্ভুত ধর্মীয় বিষয় বিদআত। আর প্রতিটি বিতআত পথভ্রষ্টতা, আর প্রতিটি পথভ্রষ্টতা জাহান্নামী। {নাসায়ী} কিন্তু তারপরও কমপক্ষে ৫৫ বছর যাবত হযরত জাবের রাঃ মসজিদে নববীতে এ বেদআত চলতে দেখেছেন। অথচ সুন্নতের হাদীস তার সামনে ছিল। যা তিনি প্রকাশ্যে না বলে কেবল ঈসা বিন জারিয়ার কানে কানে বলেছেন? আর তিনি এ আমানত এক শিয়া ইয়াকুব বিন আব্দুল্লাহর কাছে বলেছেন !!। এটা কিভাবে সম্ভব?
৩ নং দলিল
عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ يُوسُفَ، عَنِ السَّائِبِ بْنِ يَزِيدَ، أَنَّهُ قَالَ أَمَرَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ أُبَىَّ بْنَ كَعْبٍ وَتَمِيمًا الدَّارِيَّ أَنْ يَقُومَا، لِلنَّاسِ بِإِحْدَى عَشْرَةَ رَكْعَةً
মুহাম্মদ বিন ইউসুফ সায়েব বিন ইয়াজীদ রহঃ থেকে বর্ণনা করেন যে, নিশ্চয় ওমর রাঃ ওবাই বিন কাব রাঃ ও তামীমে দারী রাঃ কে মানুষের সাথে ১১ রাকাত নামায পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন।(মুয়াত্তা মালিক-৯৮)
জবাব:
এই হাদিস দিয়েও দলিল দেয়া ঠিক নয়। কারণ-
১-হাদিসটির শব্দে পরস্পর বিরোধীতা রয়েছে। যেমন এই হাদিসের সূত্রের একজন বর্ণনাকারী মুহাম্মদ বিন ইউসুফ তার সাগরীদ ৫ জন। তার মধ্যে ৩জন ১১ রাকাত আর ১জন ১৩ রাকাত ও ১জন ২১ রাকাতের বর্ণনা নকল করেন। এছাড়া যারা ১১রাকাতের কথা বর্ণনা তাদের বর্ণনার শব্দেও রয়েছে অনেক পার্থক্য। যথা-
ক.ইমাম মালিক এনেছেন ওমর রা. ওবাই বিন কাব রা. ও তামীমে দারী রা. কে মানুষের সাথ ১১ রাকাত নামায পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
খ.হযরত ইয়াহইয়া আল কাত্তান বর্ণনা করেন-ওমর রাঃ ওবাই বিন কাব ও তামিমে দারী এর কাছে লোকদের একত্র করেন আর তারা দু’জন ১১ রাকাত নামায পড়াতেন।
গ.আব্দুল আজীজ বিন মুহাম্মদ রহঃ এর বর্ণনায় এসেছে-আমরা হযরত ওমর রাঃ এর আমলে ১১ রাকাত নামায পড়তাম।
বর্ণনাকারীর বর্ণনার ঠিক নেই, সেই সাথে এগার রাকাতের কথা বলেছেন তাদের বক্তব্যটিও পরস্পর বিরোধী। এমন বর্ণনা গ্রহণযোগ্য নয়, বরং পরিত্যাজ্য। (ইলাউস সুনান-৭/৪৮)
২-এই বর্ণনাটি হযরত ওমর রাঃ থেকে আরেকটি সহীহ ও শক্তিশালী বর্ণনার বিপরিত। হযরত ওমর রাঃ থেকে ২০ রাকাত তারাবীহের কথা ইমাম মালিক রাহঃ তার মুয়াত্তার ৪০ নং পৃষ্ঠায় ও হাফেজ ইবনে হাজার ফাতহুল বারীর ৪ নং খন্ডের ২১৯ নং পৃষ্ঠায় বর্ণনা করেন। সুতরাং বুঝা গেল এই বর্ণনাটি আমলযোগ্য নয়।
-৩ইমাম মালিক রাহঃ নিজেই এই বর্ণনাটি আমলযোগ্য মনে করেননি, তাই তিনি নিজে ৮ রাকাতের কথা বলেননা।
৪-যদি হযরত ওমর রাঃ থেকে ১১ রাকাতের বর্ণনাটি সহীহ হত তাহলে পরবর্তীতে হযরত উসমান রাঃ ও আলী রাঃ থেকে এরকম বর্ণনা ও আমল প্রমাণিত হত, অথচ তাদের থেকে এরকম বর্ণনা প্রমাণিত নয়।
এই সকল কারণে এই হাদিসটি আমলযোগ্য হিসেবে বাকি থাকেনা।
৪ নং দলীল
হযরত উবাই ইবনে কা’ব রা. থেকে বর্ণিত,
أَنَّهُ صَلَّى فِيْ رَمَضَانَ بِنِسْوَةٍ فِيْ دَارِهِ ثَمَانِ رَكَعَاتٍ
অর্থ: তিনি রমযানে তার ঘরের মহিলাদের নিয়ে আট রাকাত পড়েছেন। সূত্র: (মুসনাদে আবী ইয়ালা: ১৭৯৫, মুজামুল আওসাত: ৩৭৩
জবাব:
এই হাদীসের সূত্রের ঈসা ইবনে জারিয়া রয়েছেন, যার দূর্বল হওয়ার ব্যাপারে আমরা দুই নং হাদীসের জবাবে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
এছাড়াও উবাই ইবনে কা’ব রা. হযরত ওমর রা. এর আমলে বিশ রাকাত তারাবীর ইমামতি করেছেন যা ইতি পূর্বে অমরা বিশূদ্ধ সনদে আলোচনা করেছি। যদি আট রাকাতের হাদীসই তার নিকট গ্রহনযোগ্য হতো, তাহলে তিনি বিশ রাকাতের ইমামতি করতেন না।

সোশ্যাল মিডিয়া

Facebook
Telegram
WhatsApp
Email

সংবাদ