লোহাগাড়া থেকে মোঃ ইউসুফ ঃ খাল-বিল, পাহাড়-পর্বত ও নৈস্যর্গিক শোভামন্ডিত এ লোহাগাড়া উপজেলা। প্রাচীনকাল থেকে এ অঞ্চলটি ছিল প্রাকৃতিক প্রাচুর্যে ভরপুর। অনেক জ্ঞানী-গুণীজনের চারণভূমি এ উপজেলার সুনাম প্রাচীনকাল থেকে সুদূরপ্রসারী। অর্থনৈতিক জোন হিসেবে এর খ্যাতি ও সুনাম ব্যাপক। বনজসম্পদ ও কৃষিজপণ্য উৎপাদনে এলাকার অনেক পরিবার স্বাবলম্বী। প্রাণী ও মৎস্য সম্পদের দিক দিয়ে এক সময় বহুল আলোচিত ছিল উপজেলার জনপদগুলো। ফুলে-ফলেশোভিত সারি-সারি বৃক্ষ বাগান, গোলাভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা গরু ও মন ভরা খুশী নিয়ে জনজীবন অতিবাহিত হচ্ছিল। কিন্তু কালের অগ্রযাত্রায় থকমে গেছে সে সোনালীর দিনগুলোর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। জনসংখ্যার চাপ, অভাব-অনটন বৃদ্ধি, চাহিদা ও রূচির পরিবর্তনে শুরু হয় ভোগ-বিলাস। যে কারণে অত্র উপজেলার অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সম্ভাবনার নেপথ্যে উঁকি দিচ্ছে উন্নয়নের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।
কালের আবর্তন-বিবর্তনে অত্র উপজেলার বিভিন্ন পটভূমির পরিবর্তন ঘটে। জীবন যন্ত্রনায় শুরু হয় উপজেলা সদর বটতলী মোটর ষ্টেশনে ভয়াবহ যানজট। এখানে নেই উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা, নেই উন্নত শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ, যা আছে তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। সব মাদরাসায় নেই আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা, বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার ও অভাব রয়েছে। হাট-বাজারগুলো পড়ে আছে অযতœ-অবহেলায়। সর্বত্র ছড়িয়ে আছে অভাব-সমস্যা। শিল্পবান্ধব এলাকা হলেও শিল্প-কারখানা নেই, নেই উদ্যোগ কিংবা সুযোগ। মাদকদ্রব্য একপ্রকার সংক্রামক ব্যাধি। এর আগ্রাসনে ধ্বংস হচ্ছে সামাজিক পরিবেশ এবং বিপথগামী হচ্ছে যুবসমাজ। চাহিদার কারণে বেড়েছে জায়গা-জমির দাম। তাতে বাড়ছে ঝামেলা এবং সৃষ্টি হচ্ছে আবাসন সংকট। বিভিন্ন কারণে চাষের জমি ধ্বংস হচ্ছে এবং লোভী ও স্বার্থপর লোকদের কবলে ধ্বংস হচ্ছে বনজসম্পদ।
বর্তমানে লোহাগাড়া উপজেলা দেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় উপজেলা। শিল্প, বাণিজ্য, কৃষি, শিক্ষা ও প্রযুক্তির মাধ্যমে এ উপজেলাকে সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাওয়া খুবই সহজ। প্রয়োজনীয় পরিকল্পনার মাধ্যমে এ উপজেলা সদরকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার এর মধ্যখানে অবস্থিত বটতলী মোটর ষ্টেশনকে অত্যাধুনিক উপ-শহরে পরিণত করা যায়। কিন্তু কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও সরকারের যথাযথ পৃষ্টপোষকতার অভাবে তাও ব্যর্থ।
মংস্য চাষঃ লোহাগাড়া উপজেলায় রয়েছে মংস্য চাষের বহু উপয়োগী স্থান। খাল-বিল-পুকুর-দীঘি-ডোবা, ছড়া ও পাহাড়ি এলাকার সমতল ভূমিতে জলাধার সৃষ্ঠি করে অসংখ্য মংস্য ক্ষেতের ব্যবস্থা করা যায়। পাহাড়ের নিম্মাংশের সমতল ভূমিতে জলাধার সৃষ্টি করে মংস্য চাষ করলে অনেকেই উপকৃত হতে পারেন। কিন্তু,বিভিন্ন কারণে স্থানীদের মধ্যে এ’ব্যাপারে কোন ধরণের তেমন আগ্রহ দেখা যাচ্ছেনা। অথচ, এলাকায় রয়েছেন অসখ্য মংস্য চাষী। উপজেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া টংকাবতী, হাঙ্গর ও চাম্বী খালের উপর মির্মিত হয়েছে রাবার ড্যাম। যে কারণে এসব খালে মৌসুমী মংস্য চাষ হচ্ছে। পাহাড়ের পাদদেশে বাঁধ দিয়ে মাছের পোনা উৎপাদনের ও ব্যবস্থা করা সম্ভব। স্থানীয়দের ধারণা, পোনা উৎপাদন করে বছরে আনুমাণিক ১শত কোটি টাকার মতো উপার্জন করা যেতে পারে। এ ছাড়া আধুনিক প্রযুক্তিতে সুষ্ঠ পরিকল্পনার মাধ্যমে লোহাগাড়ায় মংস্য চাষ করলে বছরে অন্ততঃ দেড় থেকে দু’শত কোটি টাকা উপার্জন হবে বলে তাঁদের ধারণা। একই সাথে অনেক লোকের কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হবে হবে বলে তাঁরা উল্লেখ করেন। অথচ বর্তমানে অধিকাংশ মংস্য চাষী মংস্য চাষে নিরাশ হয়ে পড়েছেন। কারণ বর্ষার কোন কোন সময় তাঁরা প্রাকৃতিক দূর্যোগে মারাতœকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। বর্তমানে মাছের খাদ্য সামুগ্রীর মূল্য আকাশচুম্বী। কিন্তু, মাছ চাষীরা সরকারের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা লাভ করতে না পারায় তাঁরা মাছ চাষে উৎসাহ ও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। মাছ চাষীর দূরাবস্থা নিয়ে এহেন মন্তব্য করেছেন পদুয়া ইউনিয়নের বিশিষ্ট মাছ চাষী জাহেদুল ইসলাম। অনুরূপ সমস্যার কথা উল্লেখ করেন বিভিন্ন এলাকার মছ চাষীরাও। অনেক প্রতিকূল অবস্থা কাটিয়ে এরপরও সৃষ্টি হয়েছে বড়হাতিয়ার হরিদার ঘোনায় গভীর পাহাড়ি অঞ্চলে মংস্য খামার। এছাড়া নানা দূরাবস্থার মাঝেও একই এলাকার সাবেক মেম্বার আবদুল মোতালেব ও মংস্য চাষ করে যাচ্ছেন। কিন্তু মাছের খাবারের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে কোন মতে বাড়ির পার্শ্বে জলাভূমিতে মংস্য চাষ টিকিয়ে রেখেছেন। এমনিভাবে ছোট-বড় একাধিক মংস্য ক্ষেত গড়ে ওঠেছে চুনতি, রড়হাতিয়া, পুটিবিলা, কলাউজান ও পদুয়াসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে। প্রযোজনীয় প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি, ভালো পোনা, খাদ্য সরবরাহ, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাসহ যাবতীয় বিষয়ে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করলে মংস্য চাষীরা আগামীতে আরো অনেক সফলতা বয়ে আনতে পারবে বলে মন্তব্য করেছে। এ’প্রসঙ্গে উপজেলা মৎস্য সম্পদ কর্মকর্তা আবদুর রজ্জাক জানান, উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ব্যক্তি মালিকানাধীন ছোট-বড় ২ হাজার ৯ শত ৫২ টি পুকুর, জলাশয়ে মৎস্য ক্ষেত রয়েছে। যার আয়তন প্রায় ১ হাজার ২শত ৯১ হেক্টর। তন্মধ্যে বিজ্ঞান সম্মত উপায়ে চাষ হচ্ছে ১ শত ২৭ টি জলাশয়ে। গত অর্থবছরে এর সর্বমোট উৎপাদন ছিল ৪ হাজার ৬ শত ৯ মেঃটঃ। বর্তমানে ইউনিয়ন প্রজেক্টসমূহ বিলুপ্ত হওয়ায় প্রায় ১ লক্ষ টাকার সরকারীভাবে মাছের পোনা বিতরণ করা হয়েছে। মৎস্য চাষের অনুকূল পরিবেশে বর্তমানে বিভিন্ন এলাকার ছোট-বড় মৎস্য চাষীরা এক প্রকার হতাশ হয়ে পড়েছেন।
অপরদিকে, এ উপজেলার বনভূমিসমূহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উপজেলার পশ্চিমে, দক্ষিণে ও পূর্বে রয়েছে গভীর বনাঞ্চল। বনাঞ্চলে রয়েছে প্রচুর মূল্যবান বনজসম্পদ। তন্মধ্যে সেগুন,গর্জন,চাপালিশ, আকাশমণি,একাশিসহ আরো বিভিন্ন জাতের বৃক্ষ বাগান রয়েছে। এর মধ্যে কোনটা সরকারি, আবার কোন কোনটা বেসরকারি বা অংশিদারিত্ব বাগান। কিন্তু কোন কোন এলাকায় ভূমিদুস্যদের কবলে বনজসম্পদ উজাড় হচ্ছে। ভূমিদুস্যরা কোন কোন এলাকার বৃক্ষ বাগানে হানা দিয়ে চলে-বলে-কৌশলে অবৈধভাবে বৃক্ষ কর্তন করে হরদম অবৈধ কাঠ ও আসবাবপত্রের ব্যবসা করে যাচ্ছে। এরপর রয়েছে কোন কোন বনভূমি এলাকায় সরকারি খাস জায়গা দখল করে স্থাপনা তৈরী করেছেন। এতে কেউ কেউ পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাসও করছেন। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, সুষ্ঠ পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে সরকার যদি প্রয়োজনের বাহিরের জায়গাগুলো অংশীদারিত্ব বাগানের ব্যবস্থা করে তাহলে জনগণ যেভাবে উপকৃত হবে অনুুরূপভাবে সরকারের রাজস্ব খাত ও লাভবান হবে। তাই জাতির বিহত স্বার্থে বনজসম্পদ রক্ষণাবেক্ষণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আরো সক্রিয় ভূমিকার প্রয়োজন আছে বলে মন্তব্য করেছেন।
পোলট্রি ফার্মঃ এ উপজেলার অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম সহায়ক হল পোলট্রি ও ডেইরী ফার্ম। একদা এ খাত থেকে প্রচুর টাকা উপার্জন করেছেন খামারের মালিকেরা। প্রতিটা ইউনিয়নে একাধিক পোলট্রি ফার্ম ছিল। খামারের মালিককেরা প্রযুক্তিগতভাবে হাঁস-মুরগী পালন করে প্রচুর লাভবান হয়েছেন। বিশেষ করে লাভবান হয়েছেন হাঁস-মুরগীর ডিম বিক্রি করে। খাদ্য সামগ্রীর মূল্য ছিল স্বাভাবিক এবং চিকিৎসার ক্ষেত্রে ঔষধপত্রের মূল্য ছিল ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে। রোগ-শোকের বেলায় চিকিৎসা গ্রহণের সুযোগ ও ছিল প্রচুর। ফলে, অনেক আগ্রহী ব্যক্তি স্ব-উদ্যোগে পোলট্রি ফার্ম গড়ে তুলে। স্থানীয়ভাবে চাহদা পূরণের পর ও দূর-দূরান্তের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করতে পারতেন। সরকারের সুষ্ট পরিকল্পনা ও নজরদারি থাকলে এ খাতে প্রচুর টাকা উপার্জন করা কোন কঠিন ব্যপার নয় বলে সংশ্লিষ্টরা মন্তব্য করেছেন। কিন্তু বর্তমানে এলাকার পোলট্রি ফার্মের মালিকেরা দারুণভাবে হতাশ হয়ে পড়েছেন। তাঁরা জানান, বর্তমানে খাদ্য-সামগ্রী ও চিকিৎসার ঔষধপত্রের মূল্য পূর্বের চাইতে অনেক গুণ বেশী। যে কারণে আয়ের চেয়ে ব্যয়ের পরিমাণের পাল্লা অনেক গুণ ভারী বলে খামারের মালিকেরা জানিয়েছেন। তাঁরা আরো জানান, সময় সময় রোগের প্রাদূর্ভাব ঘটে আর্তিকভাবে তাঁদেরকে সর্বনাশ করে। তাই তাঁরা বর্তমানে পোলট্রি ফার্মে টিকে আছে আর্তিক দূরাবস্থার মধ্য দিয়ে। এ খাতকে শক্তিশালী করতে খামারের মালিকেরা সরকারের শূভদৃষ্টি দাবি করেছেন। পুটিবিলার হাছিনার ভিটা এলাকায় অবস্থিত পোলট্রি ফার্মের মালিক রফিক আহমদ জানান, পূর্বে পোলট্রি ফার্মের ব্যবসায় যেভাবে লাভবান হয়েছেন সেভাবে সমসাময়িককালে লাভের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণই বেশী। লাভ-লোকসানের ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসাটি টিকিয়ে রেখেছেন। তিনি মন্তব্য করেন, লোহাগাড়ার অর্থনৈতিক খাতসমূহের মধ্যে পোলট্রি ফার্ম ব্যবসা অন্যতম। তাই সরকারের উচিৎ এ ব্যাপাওে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে খামারীদের উন্নয়নে এগিয়ে আসা।
ডেইরী ফার্মঃ উপজেলার অন্যতম অর্থনৈতিক উন্নয়নের খাত হল প্রাণী সম্পদ। এ প্রাণী সম্পদ সংরক্ষণে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে আনুমাণিক ৪/৫ বছর পূর্বে গড়ে ওঠে ছিল লোহাগাড়া,চুনতি, আমিরাবাদ. পুটিবিলা, কলাউজান, চরম্বা প্রভৃতি ইউনিয়নে প্রায় ৪৬ টি ডেইরী ফার্ম। উন্নত জাতের মোট গরুর সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে ৬ শতাধিক। তন্মধ্যে গাভী ছিল ২শত ৯২ টি, বাদবাকিগুলো ছিল ষাঁড়। গাভীগুলো হতে ফার্মের মালিকেরা প্রায় ২ হাজার লিটারের অধিক দুধ পেতেন। ওই সময় প্রত্যেক ডেইরী ফার্মের মালিকদের মাঝে ছিল প্রচুর আগ্রহ, উৎসাহ ও উদ্দীপনা। পাশাপাশি উপজেলার বিভিন্ন জনপদের লোকালয়ের অধিকাংশ বাড়ির মধ্যে গৃহ পালিত গরু ও ছাগল ছিল প্রচুর। তাদের খাবার ছিল খড় ও ধানের খুড়া। কেউ কেউ খুড়ার সাথে খৈল, পাতার মিঠা ও ধান পঁচা মিশিয়ে দিত। ওইসব খাবারে গৃহপালিত গরু-ছাগলগুলো ছিল মোটা তাজা ও স্বাস্থ্যবান। গৃহকর্তারা সাংসারিক ব্যয়ভার নির্বাহে প্রয়োজনে হাট-বাজারে বিক্রি করে টাকা উপার্জন করতেন। পাশাপাশি ডেউরী ফার্মের মালিকেরাও স্বল্প মূল্যের খাদ্য-সামগ্রী ও ঔষধপত্র কিনে অতি সহজেই ফার্মের পশুগুলোর চিকিৎসা করতে পারতেন। এতে তাঁরা আর্থিক হয়রানির সম্মুখীন ও হতেননা। অতীতে বলতে গেলে অত্র উপজেলায় ডেইরী ফার্মের স্বর্ণযুগ ছিল। বর্তমানে সেই স্বর্ণযুগ আজ আর নেই। ডেইরী ফার্ম ব্যবসায় বড় ধরণের ধস নেমেছে। অনেকেই এ ফার্ম ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। ফার্ম মালিকদের সহিত আলাপ করে জানা গেছে, পশুর খাদ্য-সামগ্রী ও চিকিৎসা সেবার ঔষধপত্রের মূল্য অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। যে কারণে লাভের চেয়ে লোকসানের হার অনেক গুণ বেশী। তাই অনেকেই এ পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশার সহিত জড়িত হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আধুনগর মছদিয়ার আম্বিয়া-কবির এগ্রো ফার্মের মালিক মহিউদ্দীন জানান, তিনি তাঁর ফার্মে গরু মোটা-তাজাকরণ শুরু করেন কয়েক বছর পূর্বে। এ বিষয়ে তিনি প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। গরু মোটা-তাজাকরণ প্রক্রিয়ার বিষয়সমূহ তাঁর জানা আছে। সেই সুবাদে ফার্ম করার এক বছর পরে গরু বিক্রি করে তিনি লাভবান হয়েছেন। কিন্তু হঠাৎ খাদ্য-সামগ্রী ও চিকিৎসার ঔষধপত্রের মূল্য আকাশচুম্বী হওয়ায় তিনি ডেইরী ফার্ম টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন। বর্তমানে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, বর্তমানে শুধু ডেইরী ফার্ম নয় বরং গ্রামের বিভিন্ন বাড়িঘরে গরু-ছাগল লালন-পালন অনেক কমে গেছে। গত কয়েক বছর যাবৎ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় স্বশস্ত্র গরু চোরেরা হানা দিয়ে রাতের অন্ধকারে গোয়াল ঘর থেকে গরু চুরি করে গাড়িভর্তি করে নিয়ে গেছে। চোরেরা অস্ত্রধারী হওয়ায় কেউ শোর-চিৎকার করতেও সাহস পাননি। বিশেষ করে আমিরাবাদ ও লোহাগাড়ার বিভিন্ন লোকালয়ের বাড়িঘর হতে বড়-ছোট অনেকগুলো গরু চোরেরা নিয়ে গেছে। চুরিতে বাঁধা দিতে গিয়ে গরুর মালিক গুলিবৃদ্ধ হয়ে আহত হওয়ার ঘটনাও প্রমাণ আছে। তাই গরু-ছাগল লালন-পালনে একদিকে খাদ্য-সামগ্রী ও ঔষধপত্রের মূল্যবৃদ্ধি এবং অন্যদিকে চুরি আতঙ্ক। এব্যাপারে সরকারের সুষ্ঠ নজরদারি থাকলে পশু সম্পদের খাত থেকে প্রতি বছর কযেকশত কোটি টাকা উপার্জন হবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন এলাকার অভিজ্ঞমহল।
অর্তকরী ফসলঃ উপজেলার অন্যতম অর্থকরী ফসল হল ধানসহ তরি-তরকারি, শাক-সবজি ও ফলের চাষ। দেখা গেছে উপজেলার প্রায় এলাকার খালের চর বা পাহাড়ি এলাকার সমতল ভূমিতে প্রচুর পরিমাণ তরি-তরকারি ও শাক-সবজি উৎপাদন হচ্ছে। উপজেলা কৃষি অফিসার মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম জানান, এবারে উপজেলা বিভিন্ন এলাকায় ১ হাজার ৩শত ৬০ হেক্টর জমিতে শীতকালীন শাক-সবজি উৎপাদন হবে। পাশাপাশি পাহাড় বা টিলার পছন্দ মতো জায়গায় প্রচুর পরিমাণ আম,কাঁঠাল,লিচু ও লেবু উৎপাদন হচ্ছে। তন্মধ্যে পদুয়ার জঙ্গল পুদয়া, ফরিয়াদিকূল, নাওঘাটা ও কলাউজানের আদার চর এবং বড়হাতিয়ার হরিদার ঘোনাসহ তৎসংলগ্ন পাহাড়ি এলাকার সমতল ভূমিতে প্রচুর পরিমাণ শাক-সবজি ও তরি-তরকারি উৎপাদন হচ্ছে। অপরদিকে, জঙ্গল পদুয়া, কলাউজান হরিণাবিল, পুটিবিলার গৌড়স্থান, চুনতির পানত্রিশা ও বিভিন্ন এলাকায় এবং বড়হাতিয়া হরিণা ঘোনার পাহাড়ী এলাকায় আম,লিচু,লেবু ও কাঁঠাল বাগান গড়ে ওঠেছে। মাটির উর্বরতা শক্তি ও সেচের ব্যবস্থা থাকার কারণে ওইসব জায়গায় গড়ে ওঠেছে শাক-সবজি ও ফলের বাগান। এসব শাক-সবজির ক্ষেত ও ফলমূলের বাগান হতে মালিকেরা প্রচুর অর্থ উপার্জন করছেন। কলাউজান হরিণা বিল এলাকার গাজী মুহাম্মদ ইছহাক, কেয়াজুর পাড়া এলাকার বাগান মালিক মুজিবুর রহমান দুলু, চুনতি পানত্রিশা এলাকার বাগান মালিক সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আলহাজ্ব সিরাজুল ইসলাম চৌধূরী, বড়হাতিয়ার হরিদার ঘোনার বাগান মালিক সাবেক মেম্বার আবদুল মোতালেব প্রমুখ জানান, আমসহ বিভিন্ন ফলের বাগান করা তাঁদের খুবই সখ। কোন কোন বছর এ ফলমূল বিক্রি কওে তাঁরা লাভবান হন। আবার কোন কোন বছর প্রাকৃতিক দূর্য়োগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ও হন। বাগানের মালিকেরা জানান, সঠিকভাবে এবং সঠিক সময়ে সরকারের পৃষ্টপোষকতা ফেলে তাঁরা ফলমূল, শাক-সবজি ও তরি-তরকারি খাত হতে প্রচুর টাকা উপার্জন করতে সক্ষম হবেন। বিশেষ করে পাহাড়ের অনাবাদি জায়গাগুলো সংষ্কার করলে ক্ষেত-খামারের সংখ্যা আরো বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। তাতে অসংখ্য পরিবার অর্তনৈতিকভাবে লাভবানও হবেন।
ধানঃ এলাকার অন্যতম অর্থকরী শস্য ধান। দেশের অন্যান্য স্থানের মতো লোহাগাড়ায় ধান চাষীরাও অনেক এগিয়ে। তবে, আধুনিক পদ্ধিতিতে চাষাবাদ করতে চাষীদেরকে আরো উৎসাহী করে তুলতে হবে। উন্নত বীজ, সার, কীটনাশক ঔষধসহ বিভিন্ন কৃষি উপকরণ কৃষকদের মাঝে বিতরণ করতে হবে। প্রযুক্তিগতভাবে চাষাবাদ করে ফলন বাড়াতে কৃষকদেরকে পরামর্শ দানে অভিজ্ঞ করে তুলতে হবে। ফলে, ধান উৎপাদনে এলাকায় কৃষকদের মাঝে বয়ে আসবে বিরাট সফলতা। এ’ প্রসঙ্গে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জানান, এবারে ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। ফলন ভালো হওয়ায় এবার লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে প্রায় ৩২ হাজার ৫শত ৭ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হয়েছে ।
বালুঃ লোহাগাড়ার অন্যতম মূল্যবান খনিজ সম্পদ হলো খালের বালু । অত্র উপজেলায় রয়েছে ১০/১২টি ছোট-বড় খাল ও ছড়া। অধিকাংশ খালের উৎপত্তি হল পাহাড়ে। যে কারণে প্রতি বছর বর্ষায় পাহাড় থেকে নেমে আসে পনির ¯্রােতের সাথে প্রচুর বালি। বর্ষার শেষে প্রতিটা খাল ও ছড়ায় সৃষ্টি হয় বালুর চর। সরকার কয়েকটি বালির মহাল ইজারা দিলেও অসংখ্য খাল ও ছড়ায় বালি উত্তোলনের সরকারী কোন অনুমতি নেই। কিন্তু কতিপয় এলাকার কিছু অসাধু ব্যাক্তি বিভিন্ন খাল ও ছড়া হতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে জমজমাট ব্যবসা করে যাচ্ছে। পাশাপাশি চলছে অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের দূর্বার অভিযান। এ’ প্রসঙ্গে উপজেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তথা উপজেলা নিবাহী অফিসার মোহাম্মদ শরীফ উল্যাহ ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তথা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ শাহজাহান পৃথক পৃথকভাবে অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে অফিযান চালিয়ে প্রচুর পরিমাণ বালু জব্দ করেছেন এবং বালু উত্তোলন কাজে ব্যবহৃত মেশিন ও যন্ত্রপতি নষ্ট করে দেয়া হয়েছে । আবার উত্তোলিত বালু জব্দ করে নিলামে বিক্রি করা হচ্ছে। ওই বিক্রিত টাকা সরকারের রাজস্ব খাতে জমা হচ্ছে। উল্লেখ্য, লোহাগাড়ার বালুর মধ্যে ডলু খালের বালু দেশ বিখ্যাত। যে কোন নির্মাণ কাজে এ খালের বালুর চাহিদা অনেক বেশী। বর্তমানে খাল ও ছড়ার কাদা মাটি মিশ্রিত বালি দিয়ে জায়গা ভরাট কাজ চলেছে। যে কারণে খাল বা ছড়ার অধিকাংশ স্পটে বৈধ বা অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের হিড়িক লেগেই আছে। বৈধ উত্তোলনকারীর চেয়ে অবৈধ উত্তোলনকারীর সংখ্যা অনেক বেশী।
সূত্রে জানা গেছে, প্রতি ট্রাক বালুর মূল্য ১ হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা। স্থানীয় অভিজ্ঞ মহল মন্তব্য করেছেন, সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনায় বৈধভাবে বালু বিক্রি করলে সরকারের রাজস্ব খাতে প্রতি বছর লোহাগাড়া থেকে বালু বিক্রি বাবদ আনুমাণিক ১০০ কোটির অধিক টাকা সরকারের রাজস্ব খাতে জমা হবে বলে ধারণা করেছেন অনেকেই।
শিল্প কারখানাঃ শিল্প-কারখানার দিক দিয়ে লোহাগাড়া অনগ্রসর। মাত্র ছোট-খাটো ২/৩ টি উৎপাদনমুখী কারখানা রয়েছে। শিল্প কারখানার দিক দিয়ে অনগ্রসর থাকার অন্যতম কারণ হল গ্যাসের অভাব। সরকার যদি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ করে, তাহলে লোহাগাড়ার অনেক আগ্রহী ধনাঢ্য ব্যক্তি শিল্প-কারাখানা গড়ে তুলতে আগ্রহী হবেন।
অতএব, লোহাগাড়ায় রয়েছে অনেক ধরণের অভাব ও সমস্যা। কিন্তু ওই সব অভাব ও সমস্যার নেপথ্যে উঁকি দিচ্ছে উন্নয়নের সম্ভাবনা। প্রথমে উপজেলা সদর বটতলী মোটর ষ্টেশনের সমস্যাগুলোর সমধান করে। এ ষ্টেশনকে দক্ষিণ চট্টগ্রামের অন্যতম উপশহর হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এরপর সূচিত হবে লোহাগাড়ার জনগণের ভাগ্যাকাশে উন্নয়নওে নতুন দিগন্ত। এ ক্ষেত্রে একান্ত প্রয়োজন স্থানীয় জনগণের আন্তরিক সহয়োগিতা ও সরকারের পৃষ্টপোষকতা। এতে, এ লোহাগাড়া হবে সুখী, সমৃদ্ধশালী একটি উপজেলা।
