১লা চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ শনিবার বসন্তকাল

অন্যতম চিত্তবিনোদন ষ্পট লোহাগাড়ার পর্যটন দৃষ্টিনন্দন চুনতির চাম্বী লেক

লোহাগাড়া থেকে মোঃইউসুফ : স্মৃতির অতলতলে হারিয়ে যাচ্ছে লোহাগাড়ার জনপদ থেকে অনেক প্রাচীন ঐতিহ্য। সময়ের আবর্তন ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির অনেক বিস্মৃত-স্মৃতি মানুষের মন-মানসিকতার দুয়ারে প্রতিনিয়ত আঘাত হানছে। কিন্তু প্রকৃতি প্রেমিকেরা হারিয়ে যাওয়া স্মৃৃতির পাশে লুকিয়ে থাকা সংস্কৃতির উৎস খুঁজে বের করে আধুনিকতার রূপ-রস-গন্ধ মিশিয়ে জনসম্মুখে তোলে ধরছেন। অত্র উপজেলার চুনতি ইউনিয়নের জনপদে গড়ে ওঠা প্রাকৃতিক ঐশ^র্যমন্ডিত চাম্বী খাল সংযুক্ত নয়ন বিমোহী চিত্তবিনোদন স্পট চাম্বী লেক অন্যতম দর্শনীয় পর্যটন কেন্দ্র।
অপরূপ শোভামন্ডিত নৈসর্গিক সৌন্দর্যের সবুজ-শ্যামল চুনতি ইউনিয়নের বনাঞ্চলসমূহ। রকমারি বৃক্ষ, বাঁশ ও বেতে ভরপুর বনভূমি। বন্য প্রাণীর বিচরণ ও পাখির কলতান, পাতার মর্মর ধ্বনি, বনভূমির নিঃসঙ্গতা সব যেন প্রকৃতির আড়ালে লুকিয়ে থাকা অদৃশ্য এক লুকোচুরি খেলা। চুনতি ইউনিয়নের চাম্বী এলাকা একটি জনপদ। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে খর¯্রােতা চাম্বী খাল। উৎপত্তিস্থল গহীন অরণ্যের পাদদেশে। এলাকার অসংখ্য খেটে খাওয়া মানুষ কৃষি নির্ভরশীল। চাম্বী খালকে কেন্দ্র করে কৃষি ও মৎস্যসম্পদ উন্নয়নে সুদূরপ্রসারী স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে আসেন প্রকৃতি প্রেমিকেরা।
চুনতি ইউনিয়নের পানত্রিশা একটি গ্রাম। গ্রাম সংলগ্ন রয়েছে বনাঞ্চলের অফুরন্ত প্রাকৃতিক রত্মভান্ডার। বয়ে গেছে খর¯্রােতা চাম্বী খাল। উচুঁ-নীচু,আঁকা-বাঁকা পথ পেরিয়ে মিলিত হয় গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খর¯্রােতা ডলুখালের সহিত। পানত্রিশা গ্রামের জয়নগর এলাকায় একটি রাবার ড্যাম স্থাপন করার স্বপ্ন দেখেন তৎকালীন ইউপি চেয়ারম্যান এবং পার্শ্ববর্তী ফারাঙ্গা গ্রামের বাসীন্দা আলহাজ্ব সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ১৯৯৮ সালে রাবার ড্যাম স্থাপনে তাঁর চিস্তাধারা ক্রমশঃ গতিশীল হতে থাকে। তাঁর ধারণা, উল্লেখিত স্থানে রাবার ড্যাম স্থাপিত হলে কৃষি নির্ভরশীল এলাকার বিশাল জনগোষ্ঠী কৃষিক্ষেত্রে উপকৃত হবেন, অনুরূপভাবে মৎস্য সম্পদ বৃদ্ধিকরণে ও সুযোগ পাবেন। ফলে, ১৯৯৮ সালে তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পুরোপুরি উদ্যোগ নেন। তৎকালীন তথা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব ও চুনতির কৃতি সন্তান প্রয়াত মেজর জেনারেল মিঞা মোঃ জয়নাল আবেদীন বীর বিক্রম, পিএসসি’র প্রচেষ্টা এলজিইডি’র অংশগ্রহণমূলক ক্ষুদ্রাকার পানি সম্পদ সেক্টর প্রকল্পের অধীনে রাবার ড্যাম স্থাপন প্রক্রিয়ার প্রাথমিক কাজ শুরু হয়। তৎকালীন সময়ে ১০ টি রাবার ড্যাম বাস্তবায়ন প্রকল্পের সাথে উক্ত রাবার ড্যাম স্থাপন প্রকল্পটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
অবহেলিত জনপদে চাম্বী খালের উপর রাবার ড্যাম স্থাপনের কথা প্রচার হলে স্থানীয় সর্বশ্রেণীর মানুষের মাঝে আনন্দ-খুশীর জোয়ার বইতে থাকে। জনগণের সাড়া ও উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখে উদ্যোক্তারা এ’স্থানকে চাম্বী লেক নাম দিয়ে অন্যতম পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তোলার চিন্তা-ভাবনা শুরু করেন। “পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি ”- কথাটি চিরন্তন সত্য। অবশেষে ২০১৫ সালে রাবার ড্যাম স্থাপনের কাজ শুরু হয়। একই সময় এলাকার কৃষকদের নিয়ে গঠিত হয়“ চাম্বী খাল পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি”। এলজিইডি’র অংশগ্রহণমূলক ক্ষুদ্রাকার পানি সম্পদ সেক্টরের অধীনে উত্তর-দক্ষিণ ২৫ মিঃ দৈর্ঘ্যের রাবার ড্যাম স্থাপিত হয়। ২০১৮ সালের ২০ জানুয়ারী এ’ রাবার ড্যাম আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন হয়। আবার রাবার ড্যামের উপর নির্মিত হয়েছে সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দন একটি ফুট ব্রিজ।
বলা বাহুল্য, অত্র উপজেলায় কোন বিনোদন বা পর্যটন স্পট ছিলনা। চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা না থাকায় জ্ঞান পিপাসুরা অবকাশ যাপনে আত্মসন্তুষ্টি লাভ করা থেকে বঞ্চিত ছিল। চাম্বী লেক কর্তৃপক্ষ এ’ ব্যাপারে চিন্তা করে নতুন আঙ্গিকে গড়ে তোলেন চাম্বী লেক পর্যটন কেন্দ্র। রাবার ড্যামের উপরিভাগে প্রায় ২ কিঃমিঃ এলাকা জুড়ে রয়েছে জমানো পানির স্তর। এতে বিভিন্ন এলাকার কৃষক যেভাবে উপকৃত হচ্ছেন এবং পাশাপাশি অসংখ্য চাষাবাদের জমি চাষের আওতাভুক্ত হয়। উপকৃত হচ্ছেন চাষীরা এবং ক্ষেত-খামার করতে পানি সেচের সুবিধে পাচ্ছেন উপর এবং নীচের অংশ সংশ্লিষ্ট কৃষকেরা।
চুনতির এ’চাম্বী লেক বর্তমানে অত্র উপজেলার একমাত্র চিত্তবিনোদন স্পট। এমন কি এক প্রকার গ্রামীণ এলাকার মিনি পর্যটন কেন্দ্র। প্রকৃতির সবুজ-শ্যামল পরিবেশে এ’চাম্বী লেক সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সারাক্ষণ মুখরিত অসংখ্য দর্শনার্থীদের পদচারণায়। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সকল বয়সের লোকদের আসা-যাওয়ার এ’বিনোদন স্পট অত্যাধিক জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে। চারিদিকে রয়েছে কর্মব্যস্ত মানুষের কোলাহল। সবুজ পাহাড়ঘেরা প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়ে ওঠা এ’চিত্ত বিনোদন কেন্দ্রে রয়েছে কৃত্রিম পানির ফোয়ারা, বন্য পশু-পাখির ভাস্কর্য,বিভিন্ন শ্রেণীর বানর,পানির উপর ভাসমান স্পিড বোট, প্যাডেল বোট, লাইফ বোট, ইঞ্জিন চালিত নৌকা ও ফ্যামিলি ট্রেনসহ আরো বিভিন্ন প্রকার দর্শনীয় জিনিসপত্র। লেক চত্বরে রয়েছে রেস্টুরেন্ট, বিশ্রামাগার ও পিকনিক স্পট। লেকের মাঝখানে শোভা পাচ্ছে “মায়া দ্বীপ”। যাতায়াতের সুবিধায় রয়েছে দর্শনার্থীদের জন্য ড্রাম ভেলা। পর্যটকদের অবকাশ যাপনের জন্য কর্তৃপক্ষ একটি অত্যাধুনিক রিসোর্ট সেন্টার নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন।
প্রাকৃতির সবুজ মেলায় নৈসর্গিক শোভামন্ডিত চুনতির এ’চাম্বী লেক বর্তমানে প্রকৃতি প্রেমিক ও উৎসুক জনতার আনাগোনায় মুখরিত। দক্ষিণ চট্টলার অন্যতম ব্যস্ততম উপ-শহর তথা লোহাগাড়া উপজেলা সদর বটতলী মোটর ষ্টেশন সংযুক্ত দরবেশ হাট ডি.সি সড়ক দিয়ে সোজা দক্ষিণে পুটিবিলার এমচর হাট পেরিয়ে সামান্য দক্ষিণে এ চাম্বী লেকের অবস্থান। চাম্বী লেক পর্যটন কেন্দ্র বাস্তবায়ন কমিটির অন্যতম উপদেষ্টা ও চুনতি ইউনিয়নের একাধিকবার নির্বাচিত সাবেক চেয়ারম্যান আলহাজ্ব সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী জানান, চুনতি চাম্বী লেক চিত্ত বিনোদন স্পট । বর্তমানে পর্যটনকেন্দ্রের সমত‚ল্য। গ্রামীণ পরিবেশে জন্ম নিয়ে রূপ ও আনন্দদানে মুগ্ধ করছে দর্শনার্খীদেরকে। দূর-দূরান্তের এলাকা থেকে আগত দর্শনার্থীরা এই চাম্বী লেকে এসে আনন্দ উপভোগ করছেন। তাঁর ধারণা, সরকারের পৃষ্টপোষকতা ফেলে এর সুযোগ-সুবিধে, সুনাম ও প্রচার আরো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে। তা’ই এ লেকটি পূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র পরিণত করতে সরকারের শুভদৃষ্টি দাবি করেছেন তিনি। চাম্বী খাল পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতির সভাপতি শিক্ষাবিদ মাহবুবুর রহমান চৌধুরী বলেন, চুনতির পানত্রিশা একটি স্বনামধন্য গ্রাম। চাম্বী খালকে কেন্দ্র করে এ’গ্রামের পরিচিতি আরো ছড়িয়ে পড়েছে। ত্রিমুখী পরিকল্পনা নিয়ে এলাকার জয়নগরস্থ খর¯্রােতা চাম্বী খালের উপর রাবার ড্যাম স্থাপিত হয়। চিত্ত বিনোদনে আনন্দ পাচ্ছে দর্শনার্থীরা। পানি সেচ ব্যবস্থায় কুষিপণ্য উৎপাদন এবং মৎস্য চাষে মৎস্যসম্পদ বৃদ্ধিকরণ প্রভুতি মহৎ উদ্যোগ নিয়ে গড়ে ওঠেছে এ চাম্বী লেক প্রকল্প বা পর্যটন কেন্দ্র। পরিকল্পনা সুদূরপ্রসারী। কিন্তু, আর্থিক সমস্যায় বাস্তবায়নের অগ্রযাত্রা ব্যাহত বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি আরো বলেন, আনন্দ-খুশীতে মানুষের মন প্রফুল্ল থাকে। মন-মানসিকতার উৎকর্ষে মানুষের নৈতিকতা বলীয়ান হয়। এতে মানুষ খুঁজে পায় উন্নত জীবন ও চরিত্র গঠনের সুযোগ। অবকাশ যাপনে মানুষের মনে বয়ে যায় সুখ-শান্তি ও অগ্রগতির অমৃত সুধা। চিত্ত বিনোদনে মানুষের মনের চিন্তা-ভাবনার বিকাশ ঘটে। তা’ই তিনি চিত্তবিনোদনে ও কৃষিজ ও মৎস্য সম্পদ বৃদ্ধিকরণে এ’চাম্বী লেককে পর্যটন কেন্দ্রে গড়ে তোলার জন্য সরকারের হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন।
চাম্বী খালের উপর রাবার ড্যাম স্থাপিত হওয়ার এলাকার প্রায় ৫ শতাধিক হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হচ্ছে। পাশাপাশি মৎস্য চাষে উজ্জ্বল সম্ভবনা সূচীত হয়েছে। চিত্ত বিনোদন পর্যটন কেন্দ্রসহ ত্রিমুখী পরিকল্পনাধীন এ’ চাম্বী লেক প্রকল্প। এ পর্যটন কেন্দ্র সরকারের পৃষ্টপোষকতার অপেক্ষায়। স্থানীয় জনগণ ও দর্শনার্থীরা গ্রামীণ পরিবেশে এ’ পর্যটন স্পটের আশু সংষ্কারে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।